Onlinenewspapers

Monday, January 23, 2012

সত্যিই কি পৃথিবী ধ্বংস হবে ২০১২ সালে? 

 

২০১২ সাল, পৃথিবী ধ্বংসের বছর! এই বছরের ২১ ডিসেম্বর তারিখে ধ্বংস হয়ে যাবে আমাদের আবাস ভূমি এই পৃথিবী! কি অবাক হলেন, নাকি ভয় পেলেন, নাকি খবরটি বিশ্বাসই করলেন না? বিশ্বাস না করারই কথা আবার বিশ্বাস করলে ভয় পাওয়ারও কথা। কারণ এত সুন্দর পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে তাও আবার এই বছর এটা শুনতে ভয় লাগে আবার শুনলে অবিশ্বাস্যও মনে হয়। তবে এটি যতই ভয়ের খবর হোক আর অবিশ্বাস্য খবর হোক না কেন, এই ব্যাপারটি নিয়ে সমগ্র বিশ্বজুড়ে চলছে চুল-চেরা বিশ্লেষণ ও গবেষণা।
বিশ্বের দেশে দেশে সাধারণ মানুষের মাঝে এই নিয়ে শুরু হয়েছে জল্পনা, কল্পনা চিন্তা-ভাবনা সত্যিই কি ধ্বংস হয়ে যাবে পৃথিবী? বিজ্ঞানীদের ধারনা আবার অনেক বিজ্ঞানীর অগাধ বিশ্বাস যে, এই ২০১২ সালের ডিসেম্বরের ২১ তারিখই ধ্বংস হয়ে যাবে পৃথিবী। তাদের ধারনা অনুযায়ী পৃথিবী ধ্বংস হবে প্রাকৃতিক ধ্বংসযজ্ঞে বা মানুষের নিজেদের ভুলে। পৃথিবী ধ্বংসের তারিখ ঘোষণা নতুন নয়, এর আগে ২০০০ সালের ৫ মে তারিখকে বিজ্ঞানীরা পৃথিবী ধ্বংসের তারিখ হিসেবে ঘোষণা করেছিল। তবে সেদিন পৃথিবী ধ্বংস হওয়া তো দূরের কথা সেদিন পৃথিবীর কোথাও সামান্যতম দুর্ঘটনাও ঘটেনি। তবে এবার তাদের যুক্তি আরও প্রবল। আর এই বিশ্বাসকে ছড়ানো হচ্ছে বিশ্বব্যাপী মানুষের মাঝে। বিশ্বাসকে মানুষের মাঝে জোরালো করার জন্য ইতোমধ্যে 2012 নামে একটি সিনেমা তৈরি করা হয়েছে। অনলাইনের অনেক ওয়েব সাইট আবার ২১ ডিসেম্বরের দিনকে কেন্দ্র করে ক্ষণ গণনা শুরু করেছে। তাহলে কি ২০১২ সালই হবে পৃথিবীর শেষ বছর! আসুন আমরা একটু গভীরে গিয়ে রহস্যটা বোঝার চেষ্টা করি
২০১২ সালে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে এই কথাটা বিশ্বব্যাপী প্রচার করা হয়েছে মূলত ছয়টি যুক্তিকে কেন্দ্র করে। যেগুলো হলো, মায়াদের ক্যালেন্ডার, সুমেরীয়দের তত্ত্ব, সূর্যঝড়, সুইজারল্যান্ডের লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার, ভয়ঙ্কর অগ্নুৎপাত পবিত্র বাইবেলের ঘোষণা। আসুন আমরা প্রথমে পৃথিবী ধ্বংসের যুক্তিগুলোর সাথে পরিচিত হয়ে নেই।
 
(১) মায়াদের ক্যালেন্ডার: ২০১২ সালে পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার প্রধান যে যুক্তি সেটি হচ্ছে মায়াদের বর্ষপঞ্জিসভ্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন ছিল ২০০০ বছর আগেকার মায়া সভ্যতা ২৫০ থেকে ৯০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে মেক্সিকো ও মধ্য আমেরিকার বিশাল অঞ্চল জুড়ে বিকাশ লাভ করেছিল এই মায়া সভ্যতা সেই সময় মায়ারা তৈরি করেছিল এক রহস্যময় ক্যালেন্ডারমায়াদের সময় বিশ্বজুড়ে স্থাপত্য, সংস্কৃতি আর বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অগ্রগতি ছিল নজিরবিহীন প্রাচীন মিথ, জ্যোতিষশাস্ত্র কিংবা প্রাচীন বুদ্ধিমান সভ্যতার ওপরযাদের আস্থা চরম তাদের প্রথম পছন্দ মায়া সভ্যতা সভ্যতার আরও অনেক নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে এর কয়েক হাজার বছর ধরে চলা বর্ষপঞ্জিদক্ষিণ আমেরিকায় ইউরোপীয় উপনিবেশ স্থাপনের আগে এই বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করত এ অঞ্চলের মানুষপরে গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জি চালু হয়ে যায়সেই বিখ্যাত মেসো আমেরিকান লং কাউন্ট ক্যালেন্ডার পাঁচ হাজার ১২৫ বছরের বৃত্ত শেষ করছে এ বছরের ২১ ডিসেম্বর সবচেয়ে বড় ভয়ংকর ব্যাপার হলো, মায়া পঞ্জিকাতে আজ পর্যন্ত যত ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে তার প্রতিটিই কালের আবর্তে সত্য ঘটনায় পরিণত হয়েছেআর এ কারণেই পৃথিবী ধ্বংসের আশংকা নিয়ে এত বেশী আলোচনা হচ্ছেঅধিকাংশ প্রাচীন সভ্যতায় উল্লেখ থাকে যে, অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন কেউ একজন দূর থেকে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছেনজীবনের প্রতিটি খুঁটিনাটি ঘটনা সেই একজনের বিশাল বড় এক ঐশ্বরিক প্ল্যানের অংশ বিশেষআর প্রাচীন সভ্যতায় উল্লেখিত এই ঐশ্বরিক প্ল্যান বুঝতে পারার জন্য পৃথিবীর একমাত্র উপায় এই মায়ান পঞ্জিকাকিন্তু কী আছে মায়ান ক্যালেন্ডারে ? জিনিসটাই বা কি? পুরাতন সেই মায়ান সভ্যতা ইতিহাসের এক অনুপম সৃষ্টিসময় এবং সৃষ্টির সুন্দর বিন্যাস সম্পর্কে মায়ানরা অনেক আগেই অবগত ছিলেনতাদের ছিল ভবিষ্যৎ জানার নান্দনিক ক্ষমতা মায়ানরা আগে থেকেই জানতো যে চাঁদ, শুক্র এবং অন্য গ্রহ গুলো মহাবিশ্বে চক্রাকারে ঘুরছেসেই সময়েই তারা নিখুঁতভাবে সময় গণনা করতে পারততাদের একটি পঞ্জিকা ছিল যাতে সৌর বছরের প্রতিটি মিনিটের নিখুঁত বর্ণনা ছিল মায়ানরা মনে করত প্রতিটি জিনিসের পর সময়ের প্রভাব রয়েছে এবং প্রতিটি জিনিস একেক সময় একেকটি অবস্থানে বিরাজ করছেমায়ানদের কাছে মহাকাশের উপর ২২টি ভিন্ন ভিন্ন পঞ্জিকা ছিলএর মধ্যে কোন কোনও পঞ্জিকা এখন থেকে ১০ মিলিয়ন বছর আগেরআর সেগুলো এত দুর্বোধ্য যে তা বুঝতে চাইলে হিসাব-নিকাশ করার জন্য সঙ্গে অবশ্যই একজন করে স্ট্রোনমার, স্ট্রোলজার, জিওলজিস্ট এবং ম্যাথমেটিশিয়ান থাকতে হবেঅধিকাংশ আর্কিওলজিস্ট মনে করেন মায়ানরা খ্রিস্ট জন্মের প্রায় ৩ হাজার ১১৪ বছর আগে থেকে সময় গণনা করা শুরু করেছেআমাদের বর্তমান পঞ্জিকা মতে খ্রিস্টের জন্মের বছরের জানুয়ারি মাস থেকে প্রথম বছর গণনা করা হয়আর মায়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী এই বছরটাকে হিসাব করা হয় শূন্য বছরএই সময়টাকে লেখা হয় এভাবে :০-০-০-০-০ একটা নতুন চক্র শুরু হওয়ার আগের ১৩ চক্রে ৩৯৪ বছর শেষ হয়ে যাবেআর নতুন চক্রটি শুরু হবে ২০১২ সালেরসবচেয়ে আশংকার ব্যাপার হলো ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বরের পর থেকে মায়ান পঞ্জিকাতে আর কোনও দিনের উল্লেখ নেইতাই এই দিনটিকে মনে করা হচ্ছে পৃথিবীর সর্বশেষ দিনআর একটি বিষয় হলো আজ পর্যন্ত মায়ান পঞ্জিকাতে যা-ই ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে, তার প্রতিটি কথা অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত হয়েছেআজকের বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতা থেকে শুরু করে বিজ্ঞানের সব গুরুত্বপূর্ণ উত্থানের উল্লেখ মায়ানদের ক্যালেন্ডারে আগে থেকেই ছিলতাই বিশ্বের বাঘা বিজ্ঞানীরাও ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বরে পর থেকে কী ঘটতে পারে তাই নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেনবর্তমানে মানুষের চিন্তা-চেতনা এবং ধ্যান-ধারণায় অনেক পরিবর্তন এসেছেসময় এবং বিজ্ঞান সম্পর্কিত জ্ঞানের বিষয়ে মধ্য আমেরিকার মায়ান সভ্যতাই সবচেয়ে বেশি এগিয়ে ছিল এবং আছেসমগ্র পৃথিবীর মধ্যে তাদের পঞ্জিকাই সবচেয়ে বেশি নিখুঁতআজ পর্যন্ত কেউ এর কোনও খুঁত খুঁজে পানি
(২) সুমেরীয়দের তত্ত্ব: ২০১২ সালে পৃথিবী ধ্বংসের পিছনে কারণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে সুমেরীয়দের আবিষ্কৃত গ্রহ নিবিরু আর পৃথিবীর কক্ষপথ এই রেখায় চলে আসার তত্ত্ববলা হয়েছে এ দুই গ্রহের মুখোমুখি সংঘর্ষ হবে আবার যদি পুরোপুরি নাও হয় তবে পৃথিবীর একটা অংশ ছুঁয়ে যাবেতা ছাড়া নিবিরু পৃথিবীর কাছাকাছি চলে আসার ফলে দুই গ্রহের মাধ্যাকর্ষণ শক্তির ঘাত-প্রতিঘাত পৃথিবীর গতিতেও এনে দেবে পরিবর্তনকেউ কেউ প্রমাণ হিসেবে নাসার একটি পূর্বাভাসকেও ব্যবহার করছেযেখানে বলা হচ্ছে, ২০১২ সালে সূর্য তুলনামূলক ভাবে বেশি উত্তপ্ত থাকবেএ সময় সোলার ফ্লেয়ারবা সূর্যের মধ্যে বিস্ফোরণের পরিমাণ বেড়ে যাবে পৃথিবী ধ্বংসের এই ধারনাকে আরও উসকে দিয়েছে ২০০৯ সালে মুক্তি পাওয়া 2012 নামের একটি ছবি যেখানে দেখানো হয়েছে, সূর্যের উত্তাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর কেন্দ্রের উত্তাপও ভয়ংকর ভাবে বেড়ে যাচ্ছেএর ফলে গলে যাচ্ছে পৃথিবীর ভূখণ্ড পৃথিবীতে আর ভূখণ্ড বলে কিছু থাকছে নাপুরো পৃথিবী তলিয়ে যাচ্ছে পানির নিচে
(৩) সূর্যঝড়: সানস্ট্রম বা সূর্যঝড়কে বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর ভবিষ্যতের জন্য একটি ভয়ঙ্করতম হুমকি বলে মনে করছেনসূর্যের ভেতরে প্রতিনিয়ত নানা ধরনের বিস্ফোরণ থেকে তৈরি হয় এনার্জিআর সেই এনার্জি থেকে ইলেকট্রন, প্রোটনের মতো নানা পার্টিকল পৃথিবীতে এসে পৌছায় এবং এগুলোর ক্ষতিকর প্রভাব এসে পড়ে পৃথিবীর উপরসেই সঙ্গে সোলার র্স্ট্রম বা সৌরঝড় তো রয়েছেই২০১২ সালে সূর্যের সবচেয়ে বেশি পরিমাণ এনার্জি তৈরি হবে, যার নাম সোলার ম্যাক্সিমামএই সৌরঝড়ের ভয়ংকর রেডিয়েশন এবং এনার্জি নির্গমনের ফলে ভূপৃষ্ঠে বা মহাকাশে যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে নানা সমস্যা দেখে দিবেবেড়ে যেতে পারে মানুষের অসুখ বিসুখ, দুর্ঘটনা ও ভয়াবহ সব প্রাকৃতিক দুর্যোগফলে পৃথিবী এগিয়ে যাবে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে
(৪) লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার: পৃথিবীর জন্য আরেকটি সম্ভাব্য হুমকি হচ্ছে লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারপৃথিবীর জন্মমুহূর্তে পৌঁছাতে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় মাটির নিচে তৈরি করা হয়েছে মানুষের তৈরি সবচেয়ে বড় যন্ত্র লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারবিগ ব্যাংয়ের সময় মহাবিশ্বের জন্মলগ্নে পৃথিবী কি রকম ছিল তা জানতে ২৭ কি. মি. লম্বা জোড়া পাইপের ভেতর দিয়ে বিজ্ঞানীরা প্রোটনকে কোটি কোটি বার চক্কর খাওয়াবে এখানেতারপর প্রায় আলোর গতির কাছাকাছি পৌঁছে বিপরীতমুখী প্রোটনের সঙ্গে ভয়ঙ্কর ধাক্কা খেয়ে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে তৈরি হবে ডট্রিলিয়ন ডিগ্রি (১০০,০০০,০০০,০০০) সেন্টিগ্রেড উত্তাপমাল্টিপেক্সড নালগ সিগন্যাল প্রসেসরে জমা হতে থাকবে অগণিত তথ্যসেই তথ্য বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা জানবেন পৃথিবী সৃষ্টির রহস্যএই পরীক্ষাটি আগে একবার চালানো হলেও সেটি ব্যর্থ হয়েছিল ২০১২ সালে পরিপূর্ণভাবে চালানোর কথা আছে এই পরীক্ষাটি। এটিই হবে বিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ পরীক্ষা কারণ এর ফলে ঘটতে পারে ভয়ংকর দুর্ঘটনা
(৫) ভয়ঙ্কর অগ্নুৎপাত: পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর আগ্নেয়গিরি হলো আমেরিকার ইয়েলোস্টোন ভলকানোমোটামুটি প্রতি ৬,৫০,০০০ বছর পর পর ভয়ংকর অগ্ন্যুৎপাত হয় এই আগ্নেয়গিরি থেকেগবেষণা অনুসারে ২০১২ সালে ভয়ংকর বিস্ফোরণ ঘটবে আবার ইয়োলো স্টোনে হয়তো সেখান থেকে এমন ভয়াবহ অগ্ন্যুৎপাত হবে যাতে পৃথিবীর সব বায়ু মণ্ডল ঢেকে যাবে এবং ছাইয়ে চাপা পড়ে যাবে সূর্যওতখন গোটা পৃথিবী অন্ধকারে ঢেকে যাবেএভাবে কিছু দিন চললেই পৃথিবী থেকে প্রাণের স্পন্দন থেমে যাবে আবার এই অগ্ন্যুৎপাতের ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে পৃথিবীর অন্যান্য আগ্নেয়গিরিগুলো জীবিত হয়ে তৈরি করতে পারে নতুন কোনও বিগ ব্যাং।
(৬) বাইবেলের ঘোষণা: পবিত্র বাইবেলে বলা হয়েছে পৃথিবীতে ভাল-মন্দের লড়াই সার্বজনীন। এবং ভাল-মন্দের চূড়ান্ত বিচার বা লড়াইয়ের একটা শেষ পরিণতি থাকে। আর সেই শেষ পরিণতির সময় হিসেবে ২০১২ সালের দিকে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। ‘The I Ching’ নামের চীনা এক গ্রন্থেও এই বিষয়ের কথাটির উল্লেখ পাওয়া যায়।
এতক্ষণ আমরা পৃথিবী ধ্বংসের কারণগুলোর সাথে পরিচিত হলাম। এই কারণগুলো দ্বারা তাহলে কি আপনার মনে হচ্ছে পৃথিবী সত্যিই ২০১২ সালে ধ্বংস হয়ে যাবে? তাহলে আসুন এবার এর উত্তর খোজা যাক।

(১) মহাপ্রলয়ের এমন ভবিষ্যদ্বাণী অনেক বার করা হয়েছে অতীতেতখন দেখা যেত অন্ধ বিশ্বাসীমানুষেরা ঘটিবাটি নিয়ে দলে দলে উঠে যেত উঁচু পাহাড়ের গায়ে যাতে মহাপ্রলয় থেকে রক্ষা পেতেপারে এবারও তেমনিভাবে ছড়ানো হয়েছে তেমনই একটি ভবিষ্যদ্বাণী। যা দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে  বিশ্বব্যাপী। এবার গুঞ্জন ছড়ানো হয়েছে যে পৃথিবী ধ্বংসের এই দিনটি হিসাব নিকাশ করে বের করেছে প্রাচীন মায়া সভ্যতার পুরোহিতরা এবং সেটা ভুল হবার নয়২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বরই যে পৃথিবীর শেষ দিন তার প্রমাণ মায়াদের ক্যালেন্ডার বা বর্ষপঞ্জি, কারণ ঐদিন শেষ হয়ে গেছে তাদের ক্যালেন্ডার কিন্তু সমস্যা একটাইপ্রাচীন মায়ার পুরোহিতরা কখনও এমন ভবিষ্যদ্বাণী করেনিবিজ্ঞানও এটা সমর্থন করেনিমায়া সভ্যতার স্বর্ণযুগ ছিল ২৫০ থেকে ৯শ' খ্রিস্টাব্দসে সময়কার জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য ও স্থাপত্যের অসাধারণ নিদর্শন হিসেবে মায়াদের হাজার হাজার শিল্পকর্ম ও হাইরোগ্লিফ বা চিত্র লেখার অস্তিত্ব আছেতা থেকে অন্তত এইটুকু জানা যায় যে, পুনর্জন্ম ও পুনঃ সৃষ্টি নিয়ে মায়াদের মধ্যে আচ্ছন্নতা ছিলকিন্তু ভবিষ্যতের কোন আলামত নিয়ে নয়মায়াদের লোককাহিনীতে অতীত জগতের বিবরণ আছেকিন্তু বর্তমান জগত কখন কিভাবে শেষ হয়ে যাবে কিংবা আদৌ হবে কি না সে সম্পর্কিত কোন বিবরণ নেই
তারপরও মায়া পুরোহিতদের ভবিষ্যদ্বাণী বলে যা বলা হচ্ছে তা একটু খতিয়ে দেখলেই আসল রহস্যটা জানা যাবেমায়ারা সময়কে মহাপ্রলয়ের দিকে টিক টিক করে এগিয়ে চলা ঘড়ি মাত্র হিসেবে দেখত না বরং অনন্ত চক্রের এক জটিল ব্যবস্থা হিসেবে মনে করতএসব চক্রের একটি ছিল 'মায়া লং কাউন্ট' যার মেয়াদ ছিল ৫ হাজার বছরেরও বেশিআমাদের ক্যালেন্ডারে সেই চক্র শুরু হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৩১১৪ সালের আগস্ট মাসে এবং তা শেষ হবার কথা ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বর মায়া সংখ্যাতত্ত্ব অনুযায়ী যা ১৩.০.০.০যেহেতু ২১ ডিসেম্বর মায়া বর্ষপঞ্জির ঐ চক্রের শেষ তাই ঐ দিনটাকে পৃথিবী ধ্বংসের দিন বলে অপব্যাখ্যা করা হয়েছেপ্রকৃতপক্ষে এমন মনে করার কোন কারণ নেই যে, মায়ারা ভেবেছিল ঐ দিনই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে২১ ডিসেম্বর মায়া ক্যালেন্ডারের একটি চক্রের শেষ হলেও পরের দিন অর্থাৎ ২২ ডিসেম্বর থেকে মায়া বর্ষপঞ্জির নতুন একটি চক্র শুরু হবার কথানিউইয়র্কের কোলগেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মায়া সভ্যতার বিশেষজ্ঞ ডেভিড স্টুয়ার্ট বলেছেন, মায়ার লম্বা বর্ষপঞ্জি শেষ হয়ে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু পরের দিন শেষে আবারও মায়ার লম্বা বর্ষপঞ্জির নতুন যাত্রা শুরু হবে, ঠিক যেমন ৩১ ডিসেম্বর শেষে আমরা ঘরের দেয়ালে পুরনো বর্ষপঞ্জি ফেলে দিয়ে নতুন বর্ষপঞ্জি টানিয়ে দেয় কাজেই ২১ ডিসেম্বর কোনভাবেই শেষ দিন নয়
তাহলে মহাপ্রলয়ের এই ধারণার উৎপত্তি হলো কিভাবে? মেঙকোর তরতুগুয়েরো নামক জায়গায় একবার মায়া যুগের একটা চিত্রলেখর সন্ধান পাওয়া যায় সেটা ছিল এক প্রস্তর ফলকে উৎকীর্ণ শব্দাবলীতাতে ১৩.০.০.০ তারিখটির ল্লেখ ছিল১৯৯৬ সালে মায়া বিশেষজ্ঞরা সেটা পাঠ করে দ্ব্যর্থবোধক ব্যাখ্যা দেনতাঁরা বলেন, সম্ভবত এক অশুভ ঘটনার ইঙ্গিতহয়ত অন্ধকার জগতের কোন দেবতার আবির্ভাব ঘটবে এ দিনেতাঁরা এই ব্যাখ্যা অনলাইনে দিয়ে দেন পরবর্তী বছরগুলোতে তা ইন্টারনেট জুড়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে২০১২ সালে মহাপ্রলয়ের ধারণার প্রবক্তারা এটাকে মায়াদের ভবিষ্যদ্বাণীর প্রমাণ হিসেবে লুফে নেন কিন্তু প্রস্তরফলকে উৎকীর্ণ লিপির বিশেষজ্ঞরা ওই চিত্রলেখার চুলচেরা বিশ্লেষণ করে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা হাজির করেনতাদের সর্বসম্মত মত হলো মায়া চিত্রলিপিটি পৃথিবী ধ্বংসের কোন ভবিষ্যদ্বাণী ছিল নাঐ প্রস্তর ফলকে মায়ারা বলেনি ২১ ডিসেম্বর ২০১২ তারিখ পৃথিবী শেষ হয়ে যাবে
(২) সুমেরীয়দের আবিষ্কৃত গ্রহ নিবিরু আর পৃথিবীর কক্ষপথ এই রেখায় চলে আসার তত্ত্ব নিয়ে বিশ্বব্যাপী মানুষের মাঝে শুরু হয়েছে চিন্তা, ভাবনা ও আতংক। ব্যাপারটি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ নাসার কাছে এ বিষয়ে জানতে চেয়ে চিঠি পাঠাচ্ছেকেউ কেউ এমনও মন্তব্য করেছেন যে, ওই বিভীষিকা শুরুর আগেই তাঁরা সপরিবারে আত্মহত্যা করবেন! ভেবে দেখুন অবস্থাটা কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে জনগণের মধ্যে আতংক দেখে বাধ্য হয়ে নাসা এ নিয়ে একটি বিশেষ ওয়েবসাইট খুলে সেখানে বৈজ্ঞানিক যুক্তিতর্ক দিয়ে মানুষকে আশ্বস্ত করছে যে, পৃথিবী অন্তত এ বছরেই ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কোনও কারণ নেই বর্তমান নাসার বিজ্ঞানীরা বলেছেন, সুমেরীয়দের আবিষ্কৃত তত্ত্বটি ছিল অনুমান নির্ভর। কারণ, তাদের সময় বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি বর্তমান সময়ের মতো আধুনিক ছিল না। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি তাদের প্রবল আগ্রহ ছিল সেজন্য তারা বেশ কিছু তত্ত্বের উদ্ভব ঘটিয়েছিল। তবে তাদের সকল তত্ত্ব যে সঠিক হবে সে ব্যাপারে কোনও নিশ্চয়তা নেই। নিবিরু নামের কল্পিত সেই গ্রহের সঙ্গে পৃথিবীর সাক্ষাৎ হওয়ার সম্ভাবনাও নাকচ করে দিয়েছে নাসানাসার স্ট্রোবায়োলজির সিনিয়র সায়েন্টিস্ট ডেভিড মরিসন বলেছেন, ‘সুমেরীয়রা যে তত্ত্বের কথা বলেছে এ ধরনের কোনও কিছুর অস্তিত্বই নেই, সম্পূর্ণটাই কল্পনা নির্ভর। ফলে এই বিষয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই।
(৩) বিজ্ঞানীদের ধারনা অনুযায়ী ২০১২ সালে সানস্ট্রম ও সূর্য ঝড় পৃথিবী ধ্বংসের কারণ হবে। তাদের মতে ২০১২ সালে সূর্যের সবচেয়ে বেশি পরিমাণ এনার্জি তৈরি হবে, যার নাম সোলার ম্যাক্সিমামএই সৌরঝড়ের ভয়ংকর রেডিয়েশন এবং এনার্জি নির্গমনের ফলে ভূপৃষ্ঠে বা মহাকাশে যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে নানা সমস্যা দেখা দিবে ফলে বেড়ে যেতে পারে মানুষের অসুখ-বিসুখ, দুর্ঘটনা ও ভয়াবহ সব প্রাকৃতিক দুর্যোগফলে পৃথিবী এগিয়ে যাবে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে অবশ্য নাসার বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে তাদের মতামত ব্যক্ত করেছেন। তারা বলেছেন সোলার ম্যাক্সিমাম এর প্রভাবে ২০১২ সালটি হবে বিশ্বব্যাপী গরম বছর। এর প্রভাবে বিশ্বব্যাপী মানুষের মাঝে অসুখ-বিসুখ বেড়ে যেতে পারে, স্যাটেলাইট সিগনালে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে এমনকি বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পারে তবে তাতে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটবে না। যারা এমন ধারণা নির্ভর গুজব পৃথিবীর মানুষের মাঝে প্রচার করেছে তারা এটা নিয়ে বাণিজ্য করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। বিজ্ঞানী মরিসন বলেছেন, এ বছর সোলার ফ্লেয়ার একটু বেশি হবেতবে তাতে পৃথিবী ধ্বংস নয়, বড়জোর সমস্যা হতে পারে স্যাটেলাইট যোগাযোগের ক্ষেত্রে
(৪) ২০১২ সালে পৃথিবী ধ্বংসের আরেকটি প্রধান যে কারণ দাড় করানো হয়েছে সেটি হচ্ছে লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার। পৃথিবীর জন্ম রহস্য পরীক্ষা করার জন্য সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় মাটির নিচে তৈরি করা হয়েছে মানুষের তৈরি সবচেয়ে বড় যন্ত্র লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার এই পরীক্ষাটি আগে একবার করে বিজ্ঞানীরা ব্যর্থ হয়েছেন। তবে তারা এবার তথা ২০১২ সালে এই পরীক্ষাটি আবার চালানোর জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে। এবার যে পরীক্ষাটি সফল হবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। এটি যদি ব্যর্থ হয় বা কোনও প্রকার বিস্ফোরণ ঘটে তবে এর প্রভাবে ও এর রাসায়নিক পদার্থ ছড়িয়ে পড়ার ফলে বিশ্বব্যাপী মারাত্মক ধ্বংস যজ্ঞের সৃষ্টি হতে পারে। বিজ্ঞানীদের ধারনা এই পরীক্ষায় যদি কোনও দুর্ঘটনা ঘটে তবে পৃথিবীর একটি বিরাট অংশ ধ্বংস হয়ে যাবে। বিজ্ঞানীরা বলেছেন এটি হতে পারে পৃথিবীর জন্য একটি ভয়াবহ অবস্থা। অবশ্য আমরা নিজেরাই যদি নিজেদের বিপদ সৃষ্টি করি তবে তার জন্য নিশ্চয়ই ২০১২ সালেকে বা অন্য কোনও কারণকে দায়ী করলে চলবে না। 
(৫) ২০১২ সালে পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার পিছনে আরও যে কারণটি দেখানো হয়েছে সেটি হচ্ছে আমেরিকার ইয়েলোস্টোন ভলকানো আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণমোটামুটি প্রতি ৬,৫০,০০০ বছর পর ভয়ংকর অগ্ন্যুৎপাত হয় এই আগ্নেয়গিরি থেকেগবেষণা অনুসারে বলা হয়েছে ২০১২ সালে আবার ভয়ংকর বিস্ফোরণ ঘটবে ইয়োলোস্টোনে এবং তাতেই ধ্বংস হবে পৃথিবী। পৃথিবী ধ্বংসের এই মতবাদটির উত্তরে অন্য বিজ্ঞানীরা বলেছেন ধারনা করা হয় প্রতি ,৫০,০০০ বছর পর পর ভয়ংকর অগ্ন্যুৎপাত হয় এই আগ্নেয়গিরি থেকে তবে এবারও যে সেই একই ক্ষণ গণনা করে একইভাবে ২০১২ সালে আবার আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ঘটবে এবং তাতেই পৃথিবী ধ্বংস হবে এ ধরনের মতবাদের কোনও ভিত্তি নেই। আশার কথা এই যে, এখনও পর্যন্ত এই আগ্নেয়গিরি থেকে ২০১২ সালে অগ্নুৎপাতের কোনও আশংকা দেখা যায় নি। ফলে এটিও প্রমাণিত হতে যাচ্ছে একটি গুজবে।
(৬) ভাল-মন্দের শেষ যুদ্ধ হিসেবে একটি ভয়াবহ পরিণতির কথা বলা হয়েছে পবিত্র বাইবেলে। আর তা ঘটার সময় হিসেবে ২০১২ সালের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। তবে ধর্মবেত্তাদের মত এই যে, এমন একটি পরিণতির কথা বলা হয়েছে তবে সেটি যে ২০১২ সালেই হবে সেটির কোনও প্রমাণ নেই। কারণ পবিত্র বাইবেলের ইঙ্গিত হিসেবে অনেকে ২০১২ সালকে বেছে নিয়েছে তবে সেটি অবশ্যই ২০১২ সাল না হয়ে অন্য কোনও সময়ও হতে পারে। এছাড়া মহাগ্রন্থ আল কুরআন ও আল হাদিসের বর্ণনা অনুসারে পৃথিবী ধ্বংস বা কেয়ামতের আগে বেশ কয়েকটি আলামতের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। যার মধ্যে কিছু আলামত আছে ছোট এবং কয়েকটি আছে বড়। ছোট আলামতগুলো ইতোমধ্যে সম্পন্ন হলেও বড় আলামত গুলো এখনও দেখা যায়নি। বড় আলামত গুলোর মধ্যে আছে ইমাম মাহদী, ইয়াজুজ মাজুজ, দাজ্জাল ও ঈসা (আঃ) এর পৃথিবীতে আগমন। হাদীসের বর্ণনা অনুসারে কিয়ামত সংঘটিত হবে পৃথিবীতে এই বড় আলামতগুলো সংঘটিত হওয়ার পর। পৃথিবীতে কিয়ামতের এই বড় আলামতগুলো এখনও দেখা যায়নি ফলে নিশ্চিন্তে বলা যায় এখনও পৃথিবী ধ্বংসের সময় আসেনি

সবশেষে বলা যায়, পৃথিবী ধ্বংসের তারিখ এর আগে কয়েকবার ঘোষণা করা হয়েছিল কিন্তু প্রতিবারই মানুষের এই ভবিষ্যৎ বাণী মিথ্যাই পরিণত হয়েছে। মিথ্যাচার, বাণিজ্য বা সতর্ক করা যে কারণেই হোক না কেন মায়া ক্যালেন্ডার সহ বেশ কিছু সূত্রকে উপাদান বানিয়ে আবারও ঘোষণা করা হয়েছে পৃথিবী ধ্বংসের তারিখ। তবে বিশেষজ্ঞ মহল ও বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে ২০১২ সালে ডিসেম্বরের ২১ তারিখের পৃথিবী ধ্বংসের মতবাদকে মিথ্যা হিসেবে প্রমাণ করেছেন। তাই পরিশেষে এটাই বলা যায়, ২০১২ সালে পৃথিবী ধ্বংসের খবর মিথ্যা ও গুজব। তবে একটি আশংকা চিন্তার কারণ হয়ে থাকছে। আর সেটি হচ্ছে লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার পরীক্ষা। এই পরীক্ষাটি যদি এই বছর চালানো হয় এবং সেটি যদি কোনও দুর্ঘটনার সৃষ্টি করে তবে নিজেদের বিপদ নিজেরা নিয়ে এসে সেটির দোষ ২০১২ সাল বা অন্য কারও দেওয়া উচিৎ হবে না।
 


No comments:

Post a Comment